গত প্রায় দুই বছর ধরে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিশেষ করে ডলার সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পর মার্চ মাস থেকে দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই পরামর্শেই ডলারের দাম বাড়ানো বা কমানো হতো। এতে আইএমএফ আপত্তি করলে ডলারের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতেও ডলারের দাম নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ছিল। গত বছরের জুলাইয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়।
মুদ্রার বিনিময় হার হলো এমন একটি হার যার মাধ্যমে একটি মুদ্রা অন্য মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করা হয়। বিনিময় হার ব্যবস্থা একটি দেশের মুদ্রানীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তিনটি মৌলিক ধরনের বিনিময় ব্যবস্থা রয়েছে : ভাসমান, স্থায়ী ও পেগড ফ্লোট এক্সচেঞ্জ। অধিকাংশ অনেক দেশে ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে এবং হস্তক্ষেপবিহীন মান নির্ধারণে ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট’ বা ভাসমান হার ব্যবহার করা হয়। এতে বাজারে চাহিদা ও অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের দাম ওঠানামা করে।
সাধারণত, দেশের মুদ্রার বিনিময় হার ভাসমান থাকে যা বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। একটি ভাসমান বিনিময় হার বাজার দ্বারা সরবরাহ ও চাহিদার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। কিছু বিনিময় হার নির্দিষ্ট দেশের মুদ্রার মূল্যের সঙ্গে বেঁধে স্থির করা হয়। অর্থাত্ একটি নির্দিষ্ট বা পেগড রেট কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত, চার ধানের পেগড পদ্ধতি ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়; হার্ড পেগ, সফ্ট পেগ, ক্রলিং পেগ ও বাস্কেট পেগ। হার্ড পেগ সিস্টেমে একটি মুদ্রা অন্য মুদ্রার বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট হারে স্থির করা হয়, যেমন সৌদি রিয়াল যা মার্কিন ডলারে পেগ করা হয়েছে। অর্থাত্ সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মান নিজে ঠিক দেয় এবং সে অনুযায়ী লেনদেন হয়। সফ্ট পেগড সিস্টেমে বাজারের ওপর মুদ্রার মান ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে সরকার বা ব্যাংক চাইলে সফট পেগ পদ্ধতিতে ডলারের ওপর একটি সম্ভাব্য দাম ধরে দিতে পারে। অর্থাত্ মুদ্রাটিকে সাধারণত একটি ব্যান্ডের মধ্যে ভাসতে দেওয়া হয়; কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার ঘন ঘন হস্তক্ষেপ করে না। একটি মুদ্রার মূল্যের ওঠানামা নির্ধারিত ঝুড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
এসব পদ্ধতির বাইরে অর্থনীতিতে নিজ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করলে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়। ইংরেজি ক্রলিং শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে চলা বা বুকের ওপর ভার দিয়ে চলা। অর্থাত্ ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে উঠানামা করতে পারবে। আর সেই হামাগুড়ি দিতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই পদ্ধতিতে ডলারের একটি সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দাম ধরে দেওয়া হয়। এর ফলে না ডলারের দাম একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে, আবার না আকাশচুম্বী আকার ধারণ করে। মূলত অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজারে সমতা আনতে আপদকালীন পদ্ধতি হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হয়। ক্রলিং পেগ আসলে স্থির বিনিময় হারেরই আরেকটি রূপ। অর্থাত্ বিনিময় হার স্থির করা আছে, সেই স্থির করা হারের আশপাশে ডলার বিনিময় করতে হবে সব পক্ষকে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তা নির্ভর করবে। সাধারণত, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনো দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই এই পদ্ধতি বেশি দেখা যায়।
চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে মার্কিন ডলারের দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মার্কিন ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগ এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ক্রলিং পেগ মিড রেট (সিপিএমআর) নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। ফলে, তপশিলি ব্যাংকগুলো সিপিএমআরের আশপাশে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেন করতে পারবে।
মূলত নিয়ন্ত্রিত বা বেঁধে দেওয়া বিনিময় হার থেকে উন্মুক্ত বাজারদরে প্রবেশের আগের ধাপটিই মূলত ‘ক্রলিং পেগ’। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবহারের ভিত্তিতে ক্রলিং পেগকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- একটিভ ও পেসিভ পেগ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের উচ্চ ও নিম্ন সীমার একটি ব্যান্ড বেঁধে দিলে তাকে একটিভ ক্রলিং বলা হয়। অন্যদিকে, মুল্যস্ফীতির হার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয়ের হার নির্ধারণ করা হলে তাকে পেসিভ ক্রলিং বলা হয়। এর প্রাথমিক লক্ষ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করা। ক্রলিং পেগ সিস্টেমের অনেক ঝুঁকি রয়েছে যেমন: কৃত্রিম বিনিময় হার তৈরি হয়; ফটকাবাজ, ফরেক্স ব্যবসায়ী এবং বাজারে ঝুঁকি তৈরি করে যা মুদ্রা বিনিময়কে অস্থিতিশীল করে তোলে। অন্যদিকে ক্রলিং পেগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ও কারসাজির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদার রিজার্ভ হ্রাস পেতে পারে।
বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণের ঘোষণা দিলেও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ভিন্ন তথ্যই দিচ্ছে। আইএমএফ এর তথ্যানুসারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন বলিভিয়া, নিকারাগুয়া, সলমন দীপপুঞ্জ, তিউনিশিয়া ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। অন্যদিকে, বেলারুশ, হুন্ডুরাস, ইসরাইল, রুমানিয়া ও স্লোভেনিয়া বেন্ডের আওতায় ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। চীনের ভিন্ন নীতির কারণে নিকারাগুয়া এবং ভিয়েতনাম ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহার করে যাকে অনেকটা ‘বিলম্বিত পেগ’ বলে অভিহিত করা হয়। একসময় বতসোয়ানা, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে এবং কোস্টারিকার মতো দেশগুলো পরীক্ষামূল ক্রলিং পেগ নীতি অনুসরণ করলেও পরবর্তী সময় তা পরিত্যাগ করে। থাইল্যান্ডও এক সময় এটি অনুসরণ করেছিল। আবার বিশ্বের অনেক দেশই এ পদ্ধতিতে সুবিধা করতে পারে নাই। এরই মধ্যে আবার অনেক দেশ এ নীতি থেকে বের হয়েও এসেছে। সম্প্রতি এ নীতি অনুসরণের ঘোষণা দিয়েছে নাইজেরিয়া। দেশটির স্থানীয় মুদ্রা ‘নাইজেরিয়ান নাইরা’-এর বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা চলছে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে কালোবাজারে ডলারের বিপরীতে নাইরার বিনিময় হার প্রায় দ্বিগুণ। ১৯৮৮ সালে মেক্সিকান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের মুদ্রা পেসোকে ডলারের সঙ্গে পেগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে অপ্রত্যাশিত এক ঘোষণায় মেক্সিকোর মুদ্রা পেসোর অবমূল্যায়ন ঘোষণা করে এবং পরীক্ষামূলক ক্রলিং পেগিং বিনিময় হার চালু করে, কিন্তু প্রত্যাশিত ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু, এ পদ্ধতি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা অর্জন এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরো কঠিন করে তুলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত আইএমএফ ঋণ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার ‘বেইল আউট’ ঋণ নিতে হয় মেক্সিকো সরকারকে। আর্জেন্টিনায় ইউএস ডলার দুষপ্রাপ্য হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে আর্জেন্টিনায় ১ ডলারে ৩৭ পেসো এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ১৮৩ পেসো পাওয়া যেত। কিন্তু তিন মাস না যেতেই ক্রলিং পেগ নীতি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে। দেশটির খুচরা ও কালোবাজারে প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যেত প্রায় দ্বিগুণ অর্থ। এ ২০২৩ সালে আগস্টের মাঝামাঝিতে আর্জেন্টিনা ডলারের বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি গ্রহণ করে এবং প্রতি ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৫০-৩৫৫ পেসো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডলারের মূল্য ৮০০ পেসো ছাড়িয়ে যায় এবং ক্রলিং পেগ নীতি ব্যর্থ হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সময়ে কোনো দেশে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করা হলে সেটির ফল পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো দেশের রিজার্ভ দুর্বল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিনিময় হারের অস্থিরতা বেড়ে গেলে এবং একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান থাকলে সেখানে এ নীতি কাজ করে না। বরং এটি বিনিময় হারের অস্থিরতাকে আরো উসকে দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাশাপাশি হুন্ডির বাজারকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তুলতে ভূমিকা রাখে। ডলারের সংকট বিদ্যমান অবস্থায় থাকলে ক্রলিং পেগ কিছুটা সুফল দিতে পারে। কিন্তু সংকট বেড়ে গেলে এ নীতির অনুসরণ কোনো কাজে আসবে না। এ নীতি কোনো দেশে সফল হয়েছে, সেটিও তেমন ইতিহাস পাওয়া যায় না। বাস্তবতা হলো ক্রলিং পেগ ডলার শংকটকে স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক করার একটি অস্থায়ী পদ্ধতি।
0 comments:
Post a Comment